● বর্জ্য
কাকে বলে?
ব্যবহারের অযোগ্য, পরিত্যক্ত, কঠিন তরল বা গ্যসীয় অবস্থায়
আমাদের চারপাশে পড়ে থাকা বস্তু যা পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারন তাকে বলে বর্জ্য।
উদাহরণ স্বরূপ ভাঙ্গা প্লাস্টিক, ছেরা কাগজ, নোংরা জল ইত্যাদির উল্লেখ করা
যায়।
সাধারণভাবে বর্জ্য পদার্থসমূহকে তিনটি বিভাগে ভাগ করা যায় যথা কঠিন, তরল এবং গ্যাসীয় বর্জ্য।
বর্জ্য পদার্থের মধ্যে কাচ, প্লাস্টিক, টিন, ব্যাটারি, কাগজ, নানারকম ধাতব জিনিস, ছাই, কাপড় বা ন্যাকড়া, টায়ার, টিউব প্রভৃতি কঠিন বর্জ্য
পদার্থ ।
গৃহস্থালি, কলকারখানা, হাসপাতাল প্রভৃতি থেকে
নির্গত হওয়া মল-মূত্র থেকে সৃষ্ট বর্জ্য পদার্থ, বাড়িঘর-কলকারখানা নিঃসৃত
নোংরা জল, সাবান ও ডিটারজেন্ট মিশ্রিত জল ইত্যাদিকে তরল বর্জ্য বলে।
কলকারখানা ও গাড়ি থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত গ্যাস, যেমন সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড প্রভৃতিকে গ্যাসীয় বর্জ্য বলে।
● বিষক্রিয়ার ভিত্তিতে বর্জ্য পদার্থসমূহকে কয়টি বিভাগে ভাগ করা যায় ?
দুই ভাগে । যথা বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ এবং বিষহীন বর্জ্য পদার্থ ।
এগুলি কঠিন, তরল, গ্যাসীয় ও তেজস্ক্রিয় অর্থাৎ
সবরকমই হতে পারে, যেমন—পারদ, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম প্রভৃতি ধাতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ
কেন্দ্রের ছাই, অব্যবহৃত কীটনাশক, ভাঙা কম্পিউটার সামগ্রী, ব্যাটারি, নাইট্রিক অক্সাইড প্রভৃতি
বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ। এগুলি মানুষ ও পশুপাখির জন্য ভীষণ ক্ষতিকর৷
খাদ্যজাত
বর্জ্য পদার্থ, কাচ, ধুলো,
কংক্রীটের টুকরো, প্রভৃতিকে
বিষহীন বর্জ্য পদার্থ বলে।
প্রধানত সাতটি উৎস থেকে
বর্জ্য পদার্থ সৃষ্টি হয়। এগুলি হল : গৃহস্থালির বর্জ্য, শিল্পবর্জ্য, কৃষিজ বর্জ্য, পৌরসভার
বর্জ্য, জৈব বর্জ্য, চিকিৎসা-সংক্রান্তু বর্জ্য এবং তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ।
বাড়ির
দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে যেসব বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয় সেগুলিকে গৃহস্থালির বর্জ্য বলে। যেমন—শাকসবজি ও
ফলমূলের উচ্ছিষ্ট, মাছ-মাংসের ফেলে দেওয়া অংশে প্রভৃতি।
কলকারখানা
থেকে নির্গত কঠিন, তরল, গ্যাসীয়, অর্ধতরল
প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য পদার্থকে শিল্পবর্জ্য বলা হয়। যেমন চামড়া কারখানার
ক্রোমিয়াম যৌগ, আকরিক নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় নির্গত নানাপ্রকার ধাতু, বিভিন্ন
প্রকার রাসায়নিক পদার্থ প্রভৃতি।
কৃষিজাত দ্রব্য থেকে নির্গত বর্জ্য
পদার্থকে কৃষিজ বর্জ্য বলা হয়। যেমন আখের ছিবড়ে, খড়,
ধানের
খোসা , নারকেলের ছোবড়া , প্রাণীজ বর্জ্য প্রভৃতি।
শহরের বা পৌর এলাকার বাড়ি, অফিস, বিদ্যালয়, বাজার, রেস্টুরেন্ট, হোটেল প্রভৃতিতে সৃষ্ট বর্জ্যকে পৌরসভার
বর্জ্য বলে। এর মধ্যে থাকে শাকসবজির অবশিষ্টাংশ, কাগজ, কাপড়, ডাবের খোলা , প্লাস্টিক, ধাতব টুকরো প্রভৃতি।
প্রধানত
প্রাণী ও উদ্ভিদ থেকে যেসব বর্জ্য তৈরি হয়,
সেগুলিকে জৈব বর্জ্য বলে, যেমন-মাংস
উৎপাদনকারী কারখানাগুলি থেকে নির্গত প্রাণীজ বর্জ্য, মাছের
উচ্ছিষ্ট, ফুল-ফল-সবজি বাগানের বর্জ্য প্রভৃতি।
হাসপাতাল, নার্সিং হোম সহ বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসা কেন্দ্রের আবর্জনাকে
চিকিৎসা-সংক্রান্তু বর্জ্য বলে। যেমন সিরিঞ্জ, সুঁচ, কাঁচি, ব্রেড, তুলো, গজ, রক্ত, ব্যান্ডেজ, অপারেশন
সংক্রান্ত আবর্জনা এছাড়া ওষুধের ফয়েল, প্লাস্টিক থালা প্রভৃতি।
দুই ভাগে। যথা, অসংক্রামক বর্জ্য পদার্থ এবং সংক্রমক
বর্জ্য পদার্থ।
চিকিৎসা-সংক্রান্তু
যেসকল বর্জ্য পদার্থ থেকে রোগ ছড়ায়না তাদের অসংক্রামক বর্জ্য পদার্থ বলে। যেমন ওষুধের
ফয়েল, প্লাস্টিক থালা প্রভৃতি।
চিকিৎসা-সংক্রান্তু
যেসকল বর্জ্য পদার্থ থেকে রোগ ছড়ায় বা সংক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল তাদের সংক্রামক
বর্জ্য পদার্থ বলে। যেমন সিরিঞ্জ, সুঁচ,
কাঁচি, ব্রেড, তুলো, গজ, রক্ত, ব্যান্ডেজ, অপারেশন
সংক্রান্ত আবর্জনা ইত্যাদি।
পারমাণবিক
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য, যেমন ছাই, ভারী জল, চিকিৎসায়
ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ প্রভৃতি।
জল দূষিত হয়ে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের নানাভাবে ক্ষতি হচ্ছে, তাদের বংশবিস্তার
বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ও সর্বোপরি জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে।
বর্জ্য পদার্থ পচনের ফলে বায়ুদূষণ ঘটে। তাছাড়া জমা বর্জ্য
পদার্থে আগুন লাগলেও বায়ু দূষিত হয়। এর ফলে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
গৃহস্থালি ও কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, যেমন ডিটারজেন্ট পাউডার, কীটনাশক, প্লাস্টিক, পলিথিন, ধাতুকণা প্রভৃতি মৃত্তিকার
সঙ্গে মিশে মৃত্তিকা দুষণ করে। তার ফলে মৃত্তিকার উর্বরতা নষ্ট হয় এবং মৃত্তিকা
বন্ধ্যা হয়ে যায়। মৃত্তিকা দূষণ উদ্ভিদ খাদ্যশৃঙ্খলের মধ্যে দিয়ে উৎপাদক দেহে
প্রবেশ করে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে।
হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে সংক্রামক ও অসংক্রামক
বর্জ্য মিশে গেলে শুধু ওইসব প্রতিষ্ঠানেই নয়, আশেপাশের এলাকাতেও বিভিন্ন
প্রকার রোগ, যেমন টিটেনাস, হেপাটাইটিস, আন্ত্রিক, চর্মরোগ, অ্যালার্জি, ফুসফুসের রোগ, টাইফয়েড প্রভৃতি দ্রুত
ছড়িয়ে পড়ে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি হল এই 3R, যথা: Reduce (পরিমাণ হ্রাস), Reuse
(পুনর্ব্যবহার)
ও Recycle (পুনর্নবীকরণ)। এই তিনভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
করা যায়।
গৃহস্থালি, কলকারখানা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান
প্রভৃতিতে যাতে বেশি বর্জ্য তৈরি না হয়, তাই জিনিসের ব্যবহার কমানো, জিনিস অপচয় না করা, জীবনযাত্রার মান পালটে
চাহিদাকে সীমিত রাখা, ব্যবহৃত জিনিস সরাসরি ফেলে না দিয়ে
জমিয়ে রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে বর্জ্যের পরিমাণ কমানো যেতে পারে।
কোনো
পরিবর্তন না করে বর্জ্য পদার্থ ব্যবহার করলে তাকে বলা হয় পুনর্ব্যবহার। যেমন ফেলে
দেওয়া জিনিস থেকে খেলনা, ঘর সাজানোর জিনিস, লেখার
সামগ্রী প্রভৃতি তৈরি করা হয়।
এই
পদ্ধতিতে বর্জ্য পদার্থকে পুনরায় প্রক্রিয়াকরণ বা পুনরাবর্তনের মাধ্যমে
ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়। এর ফলে একই দ্রব্য বা নতুন দ্রব্য উৎপাদিত হয়। যেমন লোহা
বা অ্যালুমিনিয়াম সামগ্ৰী সমূহ ব্যবহারের ফলে অকেজো হয়ে গেলেও পুনরায় গলিয়ে
নতুন নতুন লোহা ইস্পাত বা অ্যালুমিনিয়াম সামগ্রী প্রস্তুত করে ব্যবহার করা যায়।
কঠিন
বর্জ্য পদার্থ ব্যবস্থাপনার প্রথম পর্যায়টি হল বর্জ্যের পৃথকীকরণ। প্রকৃতির সঙ্গে
বর্জ্য পদার্থের প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে কঠিন বর্জ্য পদার্থসমূহকে দুই ভাগ
করা হয়— জৈব ভঙ্গুর এবং জৈব অভঙ্গুর।
উদ্ভিদ
ও প্রাণীজাত সব বর্জ্য পদার্থই জৈব ভঙ্গুর বা জীব বিশ্লেষ্য। জৈব ভঙ্গুর বর্জ্য
পদার্থ হল সেই সব বর্জ্য পদার্থ যেগুলি যেকোনো ধরনের অনুজীব বা অণুবীক্ষণিক
বিয়োজক দ্বারা বিশ্লিষ্ট হয়।
মানুষের
তৈরি বিভিন্ন ধরনের পলিমার, যেমন প্লাস্টিক, পলিথিন
এছাড়া, ডি. ডি. টি এর মতো বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, কাচ
ইত্যাদি বর্জ্য পদার্থ গুলিকে জৈবিক পদ্ধতিতে ভাঙা যায় না ফলে যুগ যুগ ধরে অবিকৃত
অবস্থায় পড়ে থাকে তাই এদের জৈব অভঙ্গুর বর্জ্য পদার্থ বলে।
একটি
নির্দিষ্ট স্থানে এক স্তর কঠিন জৈব বর্জ্য পদার্থ এবং এক স্তর মাটি দিয়ে
ক্রমান্বয়ে স্তর তৈরি করা হয়। মাটির নীচে থাকা এই বর্জ্য জৈব ভঙ্গুর বলে এদের
পচন হয় এবং তার ফলে প্রক্রিয়া চলার সময় এর থেকে মিথেন, অ্যামোনিয়া
প্রভৃতি গ্যাস উৎপন্ন হয় এবং নীচু জমি ভরাট করা হয়।
কম্পোস্টিং
হল জৈব বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদনের একটি পদ্ধতি। এভাবে উৎপন্ন জৈব সার থেকে
উদ্ভিদ তার বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, ফসফেট
প্রভৃতি পুষ্টিকর উপাদান লাভ করে থাকে।
প্রথমে মাটিতে পরিখা বা ট্রেঞ্চের মতো
একটি অগভীর লম্বা গর্ত করা হয় এবং তার মধ্যে নানা ধরনের জৈব বর্জ্য ফেলে তার ওপরে
মানুষ, গবাদিপশুর মলের স্তর তৈরি করা
হয়। এরপর ওগুলি ব্যাকটেরিয়া, জৈব
বর্জ্য থেকে সৃষ্ট জৈব সার। কেঁচো প্রভৃতি দ্বারা বিয়োজিত হয়ে কম্পোস্ট সার তৈরি
হয়।
শহরাঞ্চলে
গৃহস্থালির মল, মূত্র মিশ্রিত নোংরা জল পয়ঃপ্রণালীর মাধ্যমে শহরের বাইরে
নিয়ে গিয়ে কোনো জলাভূমিতে জমা করা হয়। কালো রঙের এই
তরল বর্জ্যকে বিভিন্ন প্রকার ব্যাকটেরিয়া জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিয়োজিত
করে। এরপর ওই তরল বর্জ্য নিকাশি পদ্ধতির মাধ্যমে পরিষ্কার করা হয়।
স্ক্রাবার
হল একপ্রকার যন্ত্র যার সাহায্যে কলকারখানা থেকে যে বায়ু নির্গত হয়, তার
মধ্যে নানা ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, ভারী
ধাতুকণা প্রভৃতি সহজেই পরিশ্রুত করা যায়।
No comments:
Post a Comment