ভারতের অঙ্গরাজ্য গুলির মধ্যে পূর্বাঞ্চলের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তরে হিমালয় পর্যন্ত প্রসারিত। ভারতের আর কোনো অঙ্গরাজ্যের এইরূপ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবস্থান লক্ষ্য করা যায় না। অবস্থান গত, জলবায়ুগত বৈচিত্র এবং ভূমিরূপের বিভিন্নতার কারনে এই রাজ্যের উপর দিয়ে অসংখ্য নদ-নদী জালের মত চতুষ্পার্শ্বে বিস্তৃত রয়েছে। এই অসংখ্য নদ নদী শুধুমাত্র নৌ পরিবহনই নয়, এই রাজ্যের আর্থ সামাজিক পরিকাঠামো অর্থাৎ কৃষি, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য, সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে নদী গুলির প্রভাব সুস্পষ্ট। তাছাড়া রাজ্যবাসীর চারিত্রিক কাঠামোর উপর নদী গুলির সুদুর প্রসারি প্রভাব রয়েছে, তাই আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে স্বাভাবিক ভাবেই নদীমাতৃক রাজ্য বলে।
পশ্চিমবঙ্গের নদ-নদীর শ্রেণীবিভাগ কর এবং বৈশিষ্ট্য সহ এদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধর ।
বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি ভেদে বিভিন্ন বিজ্ঞানীগণ পশ্চিমবঙ্গের নদ-নদীকে প্রধান তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এই বিভাগ গুলি হল যথাক্রমে ১) বরফ গলা জলে পুষ্ট নদ-নদী বা উত্তরবঙ্গের নদ নদী সমূহ ২) বর্ষন পুষ্ট বা বৃষ্টির জলে সৃষ্ট নদ-নদী বা দক্ষিণবঙ্গের নদ-নদী সমূহ এবং ৩) জোয়ারের জলে প্লাবিত নদ-নদী বা সুন্দরবন অঞ্চলের নদ নদী সমূহ।
A) বরফ গলা জলে পুষ্ট নদ-নদী বা উত্তরবঙ্গের নদ নদী
উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিনে গঙ্গা নদী পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের সীমা নির্ধারিত। উত্তরবঙ্গ উত্তরে অবস্থিত হিমালয় পর্বতের হিমবাহ থেকে যে সকল নদী গুলি সৃষ্টি হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গঙ্গা, তিস্তা, মহানন্দা, বালাসন, জলঢাকা, তোর্সা, কালজানি, রায়ডাক, সংকোশ প্রভৃতি।
গঙ্গা নদী
পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ নদী হল গঙ্গা। কুমায়ুন হিমালয় উৎপত্তি লাভ করে রাজমহল পাহাড়ের নিকট গঙ্গা নদী পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে এবং ধুলিয়ান এর নিকট দুই ভাগে ভাগ হয়ে প্রধান শাখাটি পদ্মা নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, অপর শাখাটি ভাগীরথী- হুগলি নামে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এই নদীর তীরে কলকাতা নগরীর পত্তন হয়। পরবর্তীকালে এই নদীর তীরে হুগলি শিল্পাঞ্চল বিকাশ লাভ করে। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের কৃষি, জলসেচ, ব্যবসা বাণিজ্য, নৌপরিবহন, সংস্কৃতি ও পর্যটনে এই নদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
তিস্তা নদী
উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী তথা ত্রাসের নদী হল তিস্তা। এই নদীটি সিকিমের জেমু হিমবাহ থেকে উৎপত্তি লাভ করে দার্জিলিং পাহাড়কে দুই ভাগে বিভক্ত করে দক্ষিণ পূর্বে প্রবাহিত হয়ে হলদিবাড়ির নিকট বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।তিস্তা ও তার উপনদী বাহিত পলি সঞ্চয়ে ডুয়ার্স ও বরেন্দ্রভূমির সৃষ্টি হয়েছে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে, কৃষিতে, জলসেচে তিস্তা নদীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। জলপাইগুড়ি, হলদিবাড়ি প্রভৃতি জনপদ এই নদীর তীরে গড়ে উঠেছে।
উত্তরবঙ্গের নদী গুলির বৈশিষ্ট্য
১) নদীগুলি হিমবাহের বরফ গলা জলে পুষ্ট বলে এরা নিত্যবহ।
২) নদীগুলি পার্বত্য হইতে উৎপত্তি লাভ করে খাড়া সমভূমি তে পতিত হওয়ায় নদীর প্রসস্থ এবং অগভীর, তাই বর্ষার অতিরিক্ত জলে নদীগুলি প্লাবিত হয়ে প্রতিবছর বন্যা সৃষ্টি হয়।
৩) সমভূমি অঞ্চলে নদীগুলি প্রতিনিয়ত নিজেদের গতিপথ পরিবর্তন করে।
৪) নদীগুলি খরস্রোতা বলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ।
৫) পার্বত্য প্রবাহে নদীগুলি সুগভীর গিরিখাত গঠন করে নেমে এসেছে।
৬) নদীগুলির পার্বত্য প্রবাহে একাধিক জলপ্রপাত দেখা যায়।
B) বর্ষণ পুষ্ট নদনদী বা দক্ষিণবঙ্গের নদ-নদী
দক্ষিণবঙ্গের নদ-নদী বর্ষার জলে পুষ্ট এবং এদের বেশির ভাগের উৎপত্তি স্থল হল পশ্চিমের ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল। ভূমি ভাগের ঢাল অনুসারে এই নদীগুলি পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয় ভাগীরথী- হুগলি নদীতে এসে মিলিত হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের বর্ষন পুষ্ট বা বৃষ্টির জলে সৃষ্ট নদী গুলির মধ্যে দামোদর, কংসাবতী বা কাসাই, শিলাবতী বা শিলাই, অজয়, রূপনারায়ন, ময়ূরাক্ষী, সুবর্ণরেখা, কেলেঘাই, হলদিনদী উল্লেখযোগ্য।
দামোদর
পশ্চিমবঙ্গের বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী গুলির মধ্যে দামোদর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নদী। ফিবছর বন্যার কারনে একসময় দামোদর নদকে বাংলার দুঃখ বলা হত। পরবর্তীকালে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন গঠিত হওয়ার পর নদী অববাহিকায় বাধ দিয়ে কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করে বন্যা রোধ করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি দামোদর নদের অববাহিকা অঞ্চলে গন্ডোয়ানা যুগের কয়লা সঞ্চয় থাকার ফলে এর উপর ভিত্তি করে দুর্গাপুর আসানসোল বার্নপুর কুলটি প্রভৃতি শিল্পকেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
দক্ষিণবঙ্গের নদী গুলির বৈশিষ্ট্য
১) নদীগুলি হিমবাহ পুষ্ট নয়। বর্ষনপুষ্ট হওয়ায় নদী গুলিতে বর্ষাকালে জল থাকলেও গ্রীষ্মকালে এবং শীত ঋতুতে নদী গুলি শুকিয়ে যায়।
২) উৎস অঞ্চল মালভূমির অন্তর্গত তাই উৎস অঞ্চলের নদীগুলি যথেষ্ট খরস্রোতা ।
৩) উত্তরবঙ্গের নদী গুলির তুলনায় দক্ষিণবঙ্গের নদী গুলির দৈর্ঘ্য অনেক কম।
৪) বঙ্গোপ গরের নিকটবর্তী হওয়ায় নদী গুলির মোহনা অঞ্চলে জোয়ার ভাটা লক্ষ্য করা যায়।
৫) অনিত্যবহ প্রকৃতির বলে নৌপরিবহনে এই নদীগুলি বিশেষ উপযোগী নয়।
৬) দক্ষিণবঙ্গের নদী গুলির প্রবাহ পথ ও মোহনা অঞ্চল গঙ্গার ব-দ্বীপ সমভূমির অন্তর্গত বলে, দক্ষিণবঙ্গের নদী গুলির গতিপথ অত্যন্ত আঁকাবাঁকা এবং দীর্ঘ দিনের পলি সঞ্চয়ে নদীখাত গুলি ক্রমশ ভরাট হয়ে এসেছে।
C) জোয়ার ভাটা জলে প্লাবিত সুন্দরবন অঞ্চলের নদ-নদী
জোয়ারের জলে প্লাবিত নদী বলতে সুন্দরবনের অন্তর্গত নদী এবং সামুদ্রিক খাড়ি গুলিকে বোঝায়। এরা মূলত ভাগীরথী ও হুগলি নদীর শাখানদী এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা একে অপরের সাথে যুক্ত। এই নদী গুলির মধ্যে মাতলা, হাড়িয়াভাঙ্গা, পিয়ালী, ঠাকুরান, সপ্তমুখী, গোসাবা, রায়মঙ্গল, ইচ্ছামতি প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সুন্দরবন অঞ্চলের নদী গুলির বৈশিষ্ট্য
১) সামুদ্রিক জোয়ারে নদী গুলি প্লাবিত হওয়ায় জোয়ারের সময় নদী গুলিতে নৌকা চলাচল করলেও ভাটার সময় নদীগুলি নৌপরিবহনে অযোগ্য।
২) সামুদ্রিক জোয়ারে প্লাবিত হওয়ায় নদীগুলির জল লবণাক্ত হয়ে পড়েছে।
৩) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নদীগুলি সামুদ্রিক খাড়িতে পর্যবসিত হয়েছে।
৪) নদীখাত গুলি দীর্ঘদিনের পলি সঞ্চায়ে ভরাট হয়ে পড়েছে তাই নদীগুলি অত্যন্ত অগভীর এবং অনেক সময় নদীগুলি তাদের মূল প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
৫) সামুদ্রিক জোয়ারে প্লাবিত হওয়ার ফলে মৎস্য শিকারে নদীগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি এই নদীগুলি স্থানীয় জীবনযাত্রা প্রণালীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।
No comments:
Post a Comment