কোন নদী অববাহিকা মূল নদীর সাথে তার বিভিন্ন উপনদী, শাখা নদী প্রশাখা নদী ইত্যাদির সমন্বয়ে যে বিশেষ ধরনের নকশা বা জ্যামিতিক রুপরেখা গড়ে তোলে তাকে জলনির্গম প্রণালী বা নদী বিন্যাস বলে। কতগুলি বিশেষ প্রাকৃতিক কারণ এর উপর ভিত্তি করে এই জলনির্গম প্রণালী গড়ে ওঠে, যথা -
১) শিলাস্তরের গঠন ও প্রকৃতি
২) শিলার কাঠিন্যের তারতম্য
৩) শিলাস্তরে ফাটল ও চ্যুতির উপস্থিতি
৪) ভূমির প্রারম্ভিক ঢাল
৫) অববাহিকা অঞ্চলের জলবায়ু
৬) ভূগাঠনিক শক্তি
৭) অববাহিকার সাম্প্রতিক ভূতাত্ত্বিক ও ভূগাঠনিক ইতিহাস
প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রকার নদী বিন্যাস বা জলনির্গম প্রণালী সৃষ্টি হয়েছে। এই সকল প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে গড়ে ওঠা নদী বিন্যাসের মাধ্যমে ভূমিরূপ এর সাথে আভ্যন্তরীণ গঠনের সম্পর্ক এবং শিলা লক্ষণ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
আকৃতি ও প্রকৃতির তারতম্যে বিশেষত প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে নদী বিন্যাস বা জল নির্গমণ প্রণালীকে প্রধান 12 টি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা -
1) বৃক্ষরূপী জলনির্গমন
গ্রিক শব্দ ডেনড্রন অর্থ বৃক্ষ। যখন কোন অববাহিকার প্রধান নদী, তার উপনদী ও শাখানদী সমন্বয় শাখা প্রশাখা যুক্ত বৃক্ষের মতো নকশা ফুটে ওঠে, তখন তাকে বৃক্ষরূপী নদী বিন্যাস বলে। ভূপৃষ্ঠের যেসব অঞ্চল একই ধরনের শিলায় গঠিত, অর্থাৎ শিলার ক্ষয় প্রতিরোধ ক্ষমতা একই রকম, সেই সকল অঞ্চলে বৃক্ষরূপী জল নির্গমন গড়ে ওঠে। দক্ষিণ ভারতের গোদাবরী ও তার উপনদী পেনগঙ্গা ও মঞ্জিরার সমন্বয়ে এইরূপ একটি নদী বিন্যাস সৃষ্টি করেছে।
2) পিনেট জল নির্গমন
বাস্তবে এটি বৃক্ষরূপী নদী বিন্যাসের এক বিশেষ রূপ। এক্ষেত্রে জল নির্গমন প্রণালীর প্রধান নদীর সাথে অসংখ্য উপনদী কিছুটা সমান্তরালে প্রবাহিত হয় সূক্ষ্মকোণে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়।
3) জাফরিরূপী জল নির্গমন
এই রূপ জল নির্গমন প্রণালীতে উপনদী গুলি সমান্তরালভাবে শিলাস্তরের আয়াম () বরাবর প্রবাহিত হয়ে প্রধান নদীর সাথে প্রায় সমকোণে মিলিত হয়। ভূপৃষ্ঠের যেসব অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে কঠিন ও কোমল শিলা অবস্থান করছে, সেখানে পরবর্তী নদী গুলি কঠিন শিলা এড়িয়ে দুর্বল শিলার আয়াম বরাবর প্রবাহিত হয় পরিশেষে অনুগামী নদী গুলির সাথে সমকোণে মিলিত হয় এবং এর ফলে পরবর্তী নদী গুলির দুই তীর বরাবর কঠিন শিলা স্তর শৈলশিরা রূপে অবস্থান করে। এর ফলে সামগ্রিক যে রূপ বা নকশা গঠিত হয় তা দেখতে হয় অনেকটা জাফরিন মত। বাঘেলখন্ড মালভূমিতে এই প্রকার জাফরি রূপী জল নির্গমন প্রণালী দেখা যায়।
4) আয়তক্ষেত্ররূপী জল নির্গমন
যখন প্রধান নদী ও তার উপনদী এবং শাখা নদী পরস্পর সমকোণে মিলিত হয় তখন একটি আয়তাকার নকশা ফুটে ওঠে। তাই একে আয়তক্ষেত্র রূপী জল নির্গমন বলে । মাঝারি ও অল্প বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে অধিক চ্যুতি ও ফাটল থাকলে, চুতি ও ফাটল বরাবর প্রধান নদী, উপনদী গুলি পরস্পরের সাথে সমকোণে মিলিত হয়ে এই রূপ নদী বিন্যাস গঠন করে। মধ্য ভারতের বেতোয়া ও শোন নদী অববাহিকায় এইরূপ নদী বিন্যাস লক্ষ্য করা যায়।
5) সমান্তরাল নদী বিন্যাস
সাধারণভাবে অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে ভূভাগের ঢাল যদি তীব্র হয় অথবা ভূ গাঠনিক শক্তির প্রভাবে সৃষ্ট নদী গুলি একে অপরের সাথে সমান্তরালে বা প্রায় সমান্তরালে নির্দিষ্ট ব্যবধান বরাবর প্রবাহিত হয়, তাকে সমান্তরাল নদী বিন্যাস বলে। শিবালিক পর্বতের ঢাল বরাবর এই প্রকার নদী বিন্যাস গড়ে উঠেছে।
6) কেন্দ্রমুখী নদী বিন্যাস
সাধারণভাবে কোন পর্বত বেষ্টিত অববাহিকা, কোন নিম্ন অববাহিকা অঞ্চল অথবা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ প্রান্তবর্তী উচ্চভূমি থেকে সৃষ্ট নদীগুলি পরস্পর মাঝের অবনমিত অঞ্চলটিতে মিলিত হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন দিক থেকে আগত নদীগুলি পরস্পর মিলিত হয় বলে একে কেন্দ্রমুখী নদী বিন্যাস বলে। আফ্রিকার চাঁদ, নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকায় এইরূপ নদী বিন্যাস দেখা যায়।
7) কেন্দ্রবিমুখ নদী বিন্যাস
কোন গম্বুজ পাহাড় আগ্নেয়গিরির শঙ্কু কিংবা বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের শীর্ষ দেশ থেকে নেমে আসা নদীগুলি চক্রের দন্ডের ন্যয় কেন্দ্র বা শীর্ষ থেকে বহির্মুখে প্রবাহিত হয়। একে কেন্দ্রবিমুখ নদী বিন্যাস বলে। ঝাড়খণ্ডের ছোটনাগপুর অঞ্চলে গ্রানাইট গঠিত পাহাড়ে এই প্রকার কেন্দ্রবিমুখ নদী বিন্যাস লক্ষ্য করা যায়।
8) পাঁজর আকৃতির নদী বিন্যাস
পাহাড়ি অঞ্চলে মূল নদীটি গভীর উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং দুই দিকের খাড়া ঢাল বেয়ে বয়ে আসা পরবর্তী নদী গুলি সমকোণে মিলিত হওয়ায় পাঁজরের ন্যয় জ্যামিতিক রূপরেখার সৃষ্টি হয়। একে বলে পাঁজর আকৃতির নদী বিন্যাস। এইরূপ নদী বিন্যাস দেখতে অনেকটা হেরিং মাছের কাঁটার মতো বলে একে হেরিংবোন নদী বিন্যাসও বলা হয়।
9) অঙ্গুরীয় জলনির্গমন
কোন গম্বুজাকৃতির পাহাড়ে কঠিন ও কোমল শিলা পরপর অবস্থান করলে বৈষম্যমূলক ক্ষয় কার্যের ফলে কোমল শিলা অধিক ক্ষয় পায় ফলে পর্বত কে বেষ্টন করে কতগুলি ধাপের সৃষ্টি হয়। কোন শিলায় গঠিত এই ধাপ এর উপর বা ধাপ বরাবর পর্বত কে বেষ্টন করে চক্রাকারে আংটির ন্যয় প্রবাহ পথে নদী নিচে নেমে আসে, তাই একে অঙ্গুরীয় জলনির্গমন প্রণালি বলে। রাচি মালভূমিতে নদী বিন্যাস লক্ষ্য করা যায় ।
10) অসংগত নদী বিন্যাস
নদীর উৎস অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে এই রূপ নদী বিন্যাস গঠিত হয়। যখন উপনদী গুলি প্রধান নদীর বিপরীতে প্রবাহিত হয়ে নৌকা ঠেলার আকশি বা বর্শির মতো সূক্ষ্মকোণী মিলিত হয়, তখন এই রূপ নদী বিন্যাস এর সাথে আভ্যন্তরীণ গঠনের কোন সংগতি থাকেনা । তাই একে অসংগত নদী বিন্যাস বলে। সাধারণভাবে নদী গ্রাসের ফলে অসঙ্গত জলনির্গমন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ওড়িশা রাজ্যের গর্জন হাট পাহাড়ের খান্ডিবাহালে এই রূপ নদী বিন্যাস দেখা যায়।
11) অনিয়মিত নদী বিন্যাস
প্লাবনভূমি অধ্যুষিত অঞ্চলে কোন কোন ক্ষেত্রে এই রূপ নদী বিন্যাস দেখা যায়। মূলত এক্ষেত্রে প্রবাহিত নদীগুলি কিছুদূর প্রবাহিত হয়ে প্লাবনভূমিতে হারিয়ে যায় এবং এদের শাখা নদী প্রায় থাকে না বললেই চলে। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে এই প্রকার নদী বিন্যাস লক্ষ্য করা যায় ।
12) বিনুনিরূপী নদী বিন্যাস
নদীর মোহনা অঞ্চলে বা কোন নদী পার্বত্য ভূমি ত্যাগ করে হঠাৎ সমভূমিতে নেমে এলে ভূমির ঢাল কমে যাওয়ায় নদীটি বহু শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট হয়ে পড়ে। এই শাখা নদী গুলি কখনো বিচ্ছিন্নভাবে আবার কখনো একত্রিত হয়ে এগিয়ে চলে। এর ফলে চুলের বিনুনির ন্যয় নকশা ফুটে ওঠে। তাই একে বিনুনি আকৃতির নদী বিন্যাস বলে। গঙ্গা নদীর মোহনা বিশেষত সুন্দরবন অঞ্চলে এই রূপ নদী বিন্যাস লক্ষ্য করা যায়।