হুগলি শিল্পাঞ্চলের অবস্থান ও বিস্তার এবং শিল্পাঞ্চল টি গড়ে ওঠার কারন ব্যাখ্যা কর।
পশ্চিমবঙ্গে হুগলি নদীর উভয় তীরে উত্তরে ত্রিবেণী থেকে কল্যাণী এবং দক্ষিনে উলুবেড়িয়া থেকে বিড়লাপুর পর্যন্ত প্রায় 100 কিমি দীর্ঘ এবং প্রায় 15 থেকে 20 কিলোমিটার ছড়া হুগলি নদীর উভয় তীরে প্রায় 1600 বর্গ কিমি অঞ্চলজুড়ে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম এবং ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম হুগলি শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। কলকাতা বন্দর শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই শিল্পাঞ্চল বৃহত্তর কলকাতা শিল্পাঞ্চল নামেও পরিচিত। সমগ্র ভারতের মোট শিল্প সংস্থার প্রায় 15% এই অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
গড়ে ওঠার কারন
1690 সালের 24 শে আগস্ট জব চার্নক সুতানুটি গোবিন্দপুর ও কলিকাতা নামে তিনটি গ্রাম ক্রয় করে কলকাতার পত্তন করেন। ব্রিটিশ বণিকরা এদেশে ক্ষমতা লাভের পর এই শহর ভারতের রাজধানী শহরে পর্যবসিত হয় যা এই শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার পটভূমি সৃষ্টি করে। পাশাপাশি যেসকল প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক উপাদান গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল -
প্রাকৃতিক কারন
১) নাব্য নদীপথ
বঙ্গোপসাগর থেকে 128 কিমি অভ্যন্তরে কলকাতা বন্দর হুগলি নদীর বাম তীরে অবস্থিত। এই সময় গঙ্গার প্রধান ধারা ভাগীরথী হুগলি পথে প্রবাহিত হত বলে নদীটি ছিল সুনাব্য। ফলে আমদানি ও রপ্তানির যে বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়, তা এই শিল্পাঞ্চলের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ।
২) ভূমিরূপ
হুগলি নদীর উভয় তীরে পলি সঞ্চিত হয়ে যে স্বাভাবিক বাধের সৃষ্টি হয়েছে তা ক্রমশ ঢালু হয়ে দুই দিকে প্রসারিত হয়ে যাওয়ায় জলপথ ও শিল্প কারখানা গড়ে তোলা সহজ হয়েছে।
৩) কাঁচামালের প্রাচুর্য
বিভিন্ন শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন পাট, বাঁশ, চামড়া এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের প্রয়োজনীয় ইস্পাত সংলগ্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহের বিশেষ সুবিধা থাকায় এই অঞ্চলের বিকাশ সহজ হয়।
৪) শক্তি সম্পদ
কলকাতা বা হুগলি শিল্পাঞ্চল এর অনতি - পশ্চিমেই রানীগঞ্জ ও ঝরিয়া কয়লা ক্ষেত্র অবস্থিত। তাই প্রয়োজনীয় শক্তি সম্পদ সুলভে সংগ্রহ করা যায়।
৫) জলসম্পদ
ভাগীরথী হুগলি নদী সুপেয় জলের ধারা বহন করে। তাই শিল্প এবং সংলগ্ন জনপদের প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ সহজ সাধ্য।
অর্থনৈতিক কারন
১) উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা
এই শিল্পাঞ্চলটি পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের বিভিন্ন শাখা প্রশাখাতে যুক্ত এবং একাধিক জাতীয় সড়ক, ও অন্যান্য পাকা সড়কের পাশাপাশি বিমানপথ ও নৌপথে ভারতের প্রধান প্রধান বাজার গুলির সাথে যুক্ত। তাই শিল্প সামগ্রীর চাহিদা অনুসারে উৎপাদিত পণ্য বাজারে প্রেরণ অত্যন্ত সহজ। পাশাপাশি শিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ এবং শ্রমিকদের যাতায়াত অত্যন্ত সুবিধাজনক।
২) সুলভ শ্রমিক
নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমির অন্তর্গত এই অঞ্চলটির জনবসতি প্রকৃতির তাছাড়া জীবিকার তাড়নায় বিহার ও উড়িষ্যা থেকে ছুটে আসা মানুষের ভিড়ে ভরপুর কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে শ্রমিক সুলভই নয়, যথেষ্ট সস্তা।
৩) মূলধন সরবরাহ
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রিটিশ ও স্কটিশ বণিক গণের মূলধন বিনিয়োগ এবং পরবর্তীকালে বাঙালি, মাড়োয়ারি, গুজরাটি শিল্পপতি এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক, বীমা সংস্থা, শিল্প বিকাশ ব্যাঙ্ক প্রভৃতি সংস্থার মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের সহজ সুযোগ শহরটি লাভ করেছে।
৪) উন্নত প্রযুক্তি
অঞ্চলটি পশ্চিমী কারিগরি বিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী এবং পরবর্তীতে দেশীয় ও বিদেশী প্রযুক্তির সংযুক্তি ঘটিয়ে উন্নত প্রযুক্তির সুযোগ অঞ্চলটি লাভ করেছে।
৫) ঘনবসতি
অঞ্চলটি নিবিড় বসতিপূর্ণ হওয়ায় শিল্পজাত সামগ্রীর চাহিদা সুপ্রচুর।
৬) শিল্পের পরিকাঠামো
ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে এই অঞ্চলে শিল্প গঠনে সুন্দর পরিকাঠামো গড়ে ওঠে, যার ধারা আজও বজায় রয়েছে।
৭) আমদানি ও রপ্তানির সুবিধা
কলকাতা বন্দরের সান্নিধ্য হেতু আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের সুবিধা অঞ্চলটিতে রয়েছে।
৮ ) ঐতিহাসিক পটভূমি
কলকাতা ছিল ইংরেজদের সবচেয়ে বড় ঘাটি ও ব্যবসা কেন্দ্র। তাই ইংরেজ সরকার নিজেদের স্বার্থেই এই অঞ্চলের শিল্প বিকাশে সহায়তা করে।
উক্ত কারণ গুলির উপর ভিত্তি করে এই অঞ্চলটিতে যে সকল শিল্পের বিকাশ ঘটেছে তারমধ্যে পাট শিল্প, বস্ত্রশিল্প, রাসায়নিক শিল্প, কাগজ শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, মোটর গাড়ি শিল্প, চর্ম শিল্প এবং অ্যালুমিনিয়াম শিল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
No comments:
Post a Comment