মহাবলী পূরম ও কাঞ্চী পূরম

সকাল সাতটার মধ্যেই বাস এসে হোটেলের সামনে হাজির । আমাদেরও ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়ে গেছে তাই দেড়ি না করে চটপট বাসে উঠে বসলাম । একে একে বিভিন্ন হোটেল থেকে যাত্রীরা উঠলেন, এবার আমরা রওনা দিলাম আজকের সারা দিনের উদ্দেশ্যে । আজ আমরা যাব চেন্নাই শহরটি ঘুরে মেরিনা বিচ হয়ে গোল্ডেন বিচ, এরপর কুমীর প্রজনন কেন্দ্র, সেখান থেকে মহাবলীপুরম, তারপর কাঞ্চীপুরম থেকে শ্রী পেরমবেদুর হয়ে আবার চেন্নাইএ । বাসে মোটামুটি জনা পচিশেক যাত্রী । বাঙালি মারোয়ারী পাঞ্জাবি সাবাই আছেন কমবেশি । ও হ্যা আর আছে কালো জামা প্যান্ট উত্তরীয় পরা দুই জন । বাপ- ছেলে হবে হয়তো । আমাদের গাইড একজন তামিল মুসলিম লোক, হিন্দী ভালোই বলতে ও বুঝতে পারেন । তাই ভাষাগত সমস্যা একদম নেই । মাঝেমাঝে তিনি আমাদের সাথে বাংলা পাঞ্জাবিতে কথা বলার আন্তরিক চেষ্টা করছেন । মাঝে মাঝে ভুলভাল হলেও ভালোই লাগছে । টুকটাক ইনফরমেশন দিচ্ছেন আবার মজাও করছেন আমাদের সকলের সাথে ।
   


চেন্নাই শহর এই কদিনে অনেক ঘুরেছি তাই নতুন করে কোন রোমাঞ্চ হচ্ছেনা বটে ! তবে দুটি জিনিস জানতে পেলাম, এতো দিন যাকে বিরাট শপিং মল ভাবতাম তা হল আন্না সলাই বা মাউন্ট রোডের উপর অবস্থিত চেন্নাই বিধান সভা, এবং চেন্নাইএর মেরিনা বিচের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩ কিমি যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম । 



চেন্নাই ছেড়ে আমরা চলেছি ২৫ কিমি দূরে গোল্ডেন বিচে । এটি একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন সমুদ্র সৈকত এক কথায় সমুদ্রের তীরে গড়ে ওঠা একই ছাতার তলায় ওয়াটার কিংডম, নাগরদোলা চরকি বিভিন্ন জয় রাইড ও খাবার দোকান একত্রে । গাইড আমাদের টকিট কেটে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন । বিভিন্ন মূল্যের ও বিনামূল্যের নাগরদোলা চরকি আছে । আমি গেলাম সৈকতটি দেখতে । এর নাম গোল্ডেন কেন বুঝলাম না ? দোকানীরা সবে পসার সাজিয়ে বসছেন মাত্র তাই খাবার এখনও তৈরি হয়নি । খানিক ঘোরাঘুরির পর বেরিয়ে এলাম । বাকিরা এখনো আসেনি তাই গাইডের সাথে গল্প করছি । পন্ডিচেরীর মাতৃমন্দিরে দামি সানগ্লাসটি ফেলে এসেছি ! তাই গেলাম আরেকটা কমদামী কিনতে, গাইডই দরদাম করে দিল । এরপর আমরা গেলাম কুমীর প্রজনন কেন্দ্র বা ক্রোকোডাইল পার্কে, এখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৫০০০ কুমীরের বাস । চারিদিক গাছ পালায় ছাওয়া । বিপদ একটাই, গাছে হাজার হাজার বক, তাই সাদা কালি থেকে সাবধান ! চারিদিকে অবহেলার ছাপ বর্তমান । একটি মিউজিয়ামে কুমীরের জীবনচক্র ডিম অস্থি কঙ্কাল সংরক্ষিত রয়েছে । পাশেই একটি কাঁচের ঘরে আছে পৃথিবী বিখ্যাত সরীসৃপ । নানা প্রকার সাপ দেখলাম । এখানে প্রতিদিন বিকাল বেলায় সাপ থেকে বিষ বারকরা দেখানো হয় । আশপাশ গন্ধে ম ম করছে তাই নাকচাপা দিয়ে বেরিয়ে এলাম ।
বাস চলছে East Coast Highway ধরে দক্ষিনে বাদামী বালু মাটির উপর কালো পিচের চওড়া রাস্তা । বাদিকে দিগন্ত বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর, ডানদিকে একাধিক ব্যাকওয়াটার বা সমুদ্রের জল আটকে পড়ে সৃষ্টি হওয়া লবণ হ্রদ । চারিদিকে ঝাউবন । এক কথায় অসাধারন ! একে একে পার হোলাম অশোক লিল্যান্ড মারুতি সুজুকি হুন্ডাই প্রভৃতি গাড়ি তৈরির কারখানা, সমুদ্রেরজল পরিস্রুত করে চেন্নাইএ পাঠানোর বিশালবড় প্ল্যান্ট ইত্যাদি । 
বাস এসে থামলো একটি বিশাল হোটেলের সামনে । আশেপাশে কোন দোকান নেই ! পার্কিং এ ছোট বড় অনেক গাড়ি । ভিতরে দেশি বিদেশি পর্যটকের ছড়াছড়ি । হাত ধুয়ে বসে পড়লাম খেতে । একটি থালায় দশটি সব্জি ভাজা ডালের বাটি । মাঝে দুটি রুটি ! গাইডকে দেকে বললাম আমরাতো ভাত খাব ? সে বলল রুটির পর ভাত দেবে । এই প্রথম আমার সাউথ ইন্ডিয়ান থালি খাওয়া । কম তেলও যে এতো সুন্দর রান্না হয় এই প্রথম খেলাম । শেষ পাতে আবার চাটনি দই মিষ্টি, একেবারে জামাই আদর ! আমাদের সামনে দুজন খেতে বসেছেনএকজন মহিলা ও তাঁর মা । মহিলার মাথার চুলের স্টাইলটা কেমন যেন উল্টানো টবের মতো কাটাকানে মোটা মোটা দুল । ঠিক যেন প্রজ্ঞানসূতকল্পের থেকে উঠে আসা কোন চরিত্র খেতে খেতে কথা হচ্ছিল । তাঁরা এসেছেন মালোয়েশিয়া থেকে এদিকটা ঘুরতে । আদি বাসস্থান ভারতে, তবে এখন সেখানকার একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন তাঁর কাছেই শুনলাম এককালে মহাবলী পুরম বা মামাল্লাপুরম ছিল পল্লব চোল প্রভৃতি সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য সমুদ্র বন্দর । এর সাথে উৎকল তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি বিভিন্ন বন্দরের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ! এখান থেকেই চোল রাজারা সুদূর দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় বলি সুমাত্রা জাভা প্রভৃতি দ্বীপে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল ।





এসে পৌছালাম মহাবলীপূরম বা মামল্লাপুরমে । চেন্নাই থেকে এখানকার দূরত্ব ৫৬ কিমি । এখানে রয়েছে পঞ্চরথ মন্দির, শোর টেম্পল, গুহা মন্দির প্রভৃতি দর্শনীয় স্থান বাস থেকে নেমে প্রথমেই যেটি চোখে পড়ল, তা হল অর্জুন কেভ । একটি অনুচ্চ পাথরের টিলার (পাহাড় নয়) গায়ে মহাভারতের বিশেষত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বর্ণনা খোদাই করা পল্লব স্থাপত্য প্রসঙ্গত বলা যায় পঞ্চ পান্ডবরা এখানে কখনই ছিলেন না । তবে তাদের স্মৃতিতে তৈরি করা এই গুহা যা আদি দ্রাবিড় স্থাপত্যের নিদর্শন গাইডের কাছে শুনলাম এটি একটি ভারতীয় ‘একশিলা পাথর খোদাই স্থাপত্য’ যা খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল পল্লব রাজা প্রথম মহেন্দ্রবর্মণ ও তাঁর পুত্র প্রথম নরসিংহবর্মণ (৬৩০-৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে) এর আমলে । টিলার গা বেয়ে সিড়ি উঠে গেছে । উপরে উঠলে কাছের মহাবলী পূরম সমুদ্র সৈকত ও সৈকত মন্দিরটি (Shore Temple) দেখা যায় । টিলার উপর ঢালু অংশে রয়েছে আস্ত একটি গ্রানাইট জাতীয় আগ্নেয় শিলার বিশাল বড় চাই । এটি ‘শ্রীকৃষ্ণ বাটার বল’ নামে পরিচিত । স্থানীয় মানুষের কাছে এটা খুবই বিস্ময়ের যে সুনামিতেও নাকি এটি গড়িয়ে পড়েনি ! আমি বললাম সুনামির সাথে এর সম্পর্ক কি ? গাইড আর তেমন কথা বাড়াল না । আসলে ভূগোল নিয়ে সারা বছর টানা-হ্যাচরা করে কাটে তো , তাই হয়ত Physical Weathering এর একটি উদাহরণের চেয়ে প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের শিল্পনৈপুণ্য এখন আমার কাছে অনেক বেশী আকর্ষণীয় লাগছে । এবার গেলাম বেলাভূমির সৈকত মন্দিরে । এই মন্দিরে একই সাথে পূজিত হন মহাদেব ও বিষ্ণু সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের আলোয় রঙিন হয়ে ওঠেন মন্দিরের দেবতারা পল্লব রাজাদের শিল্পনৈপুণ্যের একটি সাক্ষর হল পঞ্চরথ মন্দির। এখানে রয়েছে অনুপম ভাস্কর্য আরো শিল্পমণ্ডিত পাঁচটি মন্দির প্রসঙ্গত ১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো অর্জুন রথ সহ মহাবলীপুরমের স্মারক স্থাপত্যগুলিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয় । 


কপাল খারাপ ! তাই রাস্তায় জ্যাম থাকার জন্য কাঞ্চী পূরমে পৌছতে সন্ধ্যা নেমে গেল । প্রাচীন শহর তায় আবার তীর্থস্থান তাই পারকিং নিয়ে সমস্যা । এতো দূর থেকে এসেছি মন্দিরের ভিতরে যাবনা ? শুনলাম সন্ধ্যা আরতির পর ৭ টা নাগাদ মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে । আবার দৌড় । আমাদের উত্তর ভারতের মন্দিরের থেকে দক্ষিন ভারতের মন্দিরের ধরন অনেক আলাদা । অনেকটা দুর্গের মতো । প্রধান ফাটক পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ । চারিদিকে উচু প্রাচীর । আবার দরজা ! তার ভিতরে মূল চত্বর । এরপর মন্দির । না জানা থাকলে এক কথায় গোলক ধাঁধা ! আসলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আক্রমণ থেকে মন্দির গুলি বাচাতে এই ব্যবস্থা আরকি ! যাই হোক আমাদের সাথে সেই তামিল পিতা পুত্র থাকায় গোলক ধাঁধায় তেমন নাজেহাল হতে হোলনা । চাতাল পেরিয়ে মূল মন্দির প্রায় একবার পরিক্রমা করে তবে সিড়ি পেলাম । সোনার সিড়ি ! সন্ধ্যা রাত্রি তাই তেমন ভিড় নেই । পুরোহিত আরতি করছেন । আমাদের ঘিয়ে ভাজা খিচুড়ির মতো প্রসাদ দিলেন । এবার ভাবলাম বোধ হয় ফেরার পালা ? কিন্তু সেই তামিল দুইজন ঘড়ি দেখে, স্বর্ণ মগর স্বর্ণ মগর বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড় দিল ! যাচ্ছেলে ! বার হয়ার রাস্তা একমাত্র এরাই ভালো জানে, যেহেতু একই সাথে বাসে ফিরবো তাই এদের ধরতে লাগালাম দৌড় অনেকটা ছোট বেলার ‘চোর-পুলিশ’ খেলার মতো । ডান বাম উপর নীচ কোন দিকেই হুশ নেই ! শেষে এসে পৌছালাম একটি কাউন্টারের সামনে । তামিল তেলেগু মালায়লম অনেক ভাষাতেই লেখা আছে বুঝলাম কেবল Rs. 2/- যাইহোক তাদের দেখাদেখি আমরাও চার টাকা দিয়ে দুটি টিকিট কেটে পিছন পিছন দাড়ালাম । কিছুদূর এগিয়ে দেখি কাঠের একটি সিড়ি উপরে উঠে গেছে । চিলেকোঠায় উঠতে হবে নাকি ! সিড়িটা অনেকটা নাগরদোলায় ওঠার সিড়ির মতো । এক পাস দিয়ে উঠে অপর পাশে নামা যায় ! এবার বুঝলাম ব্যাপার কি ? আমাদের ভগবান থাকে মন্দিরের পিছনের দেওয়ালে । কিন্তু কাঞ্চীর এই স্বর্ণ মগর রয়েছে ছাদে ! তাই সবাই সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে তাঁকে স্পর্শ করে নামছে । এও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা নয়কি ! ফেরার সময় দেখলাম মন্দিরের এক কোণে প্রসাদ বিক্রি হচ্ছে । একটি লাড্ডু ২০ টাকা । কেনাকাটির পর বের হলাম মন্দির থেকে । দেখি গাইড আমার ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে । তিনজনে মিলে একটা লাড্ডু প্রসাদ ভেঙে খেলাম । সামনেই একাধিক কাঞ্চীপুরম সিল্ক শাড়ির দোকান । দোকানের ভিরতেই শাড়ি তৈরির কারখানা । বাইরে যে শাড়ি গুলির দাম তিন থেকে চার হাজার টাকা এখানে তার দাম তেরশো থেকে আঠারশো টাকার মধ্যে । আবার ৩০ শতাংশ টাকা দিয়ে বুকিং করা যায় ! VVP করে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে অনেকটা Cash on Delivery এর মতো । কেনাকাটির পর একটু খওয়া দাওয়া চাপান সেরে বাসে উঠে বসেছি । এবার শরু হল হকারদের উৎপাত । হাতে চামড়ার চপ্পল । এক জোড়া ১৫০ টাকা । বলা ভালো এই চপ্পলের দাম শেয়ার বাজারের ওঠে-পড়ে ! একটু ধৈর্য ধরতে হবে এই যা । আগরতলার এক দাদা যে চপ্পল কিনলেন ১২০ টাকা দিয়ে বাস ছাড়ার সময় তাই কিনলাম ৬০ টাকা দিয়ে !

হাইরোড ধরে বাস চলেছে উত্তর পূর্বে চেন্নাইএর দিকে । সবাই মোটামুটি ঘুমে আচ্ছন্ন । হঠাৎ গাইডের ডাকে ঘুম ভাঙল । আমরা এসেছি শ্রী পেরমবেদুরে । এক অসম্ভব নিস্তব্ধতা ! ১৯৯১ সালের ২১শে মে ভারতের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী শ্রী রাজীব গান্ধী  LTTE আততায়ী দ্বারা এখানকার এক জনসভায় নিহত হন । তাঁর সাথে শেষ হয়ে যায় ভারতের এক সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ইতিহাস । এখানে একটি সৌধ ও মিউজিয়াম রয়েছে সেখানে । 

* * * * * * * 
চেন্নাইতে প্রবেশ করেছি । একে একে সবাই নিজেদের হোটেলের সামনে নেমে যাচ্ছে । অ্যাপেলো হাসপাতালের সামনে গাড়িটা দাড় করানোয়, কমল গাইডকে বলল, তার কিছু ঔষধ নিতে হবে । গাইড বলল এখানে দেরী না করে, চেন্নাইতে খুজলেই হবে । কোন চিন্তা নেইযাই হোক রাত পোনে দশটা নাগাদ চেন্নাই সেন্ট্রালের সামনে এসে আমাদের বাস থামলো । আমরা নামতে গেলাম, গাইড বলল দাড়ান, সবাইকে নামিয়ে দিয়ে, ঔষধ কিনে তারপর আপনাদের নামিয়ে দেব ! এও বাস্তব ! হ্যাঁ, রাত দশটার সময় একটা আস্ত বাস নিয়ে, একটা নয় দুটো নয়, পাচ পাচটা অ্যাপেলো ফার্মেসি খুজে, নিজে বাস থেকে নেমে ঔষধ কিনে এনে দিল । হোটেলের সামনে নামার পর হাত নেড়ে তাঁকে বিদার জানালাম । কমিটমেন্ট দায়ব্ধতা কাকে বলে আজ শিখলাম । জীবনে তাঁর সাথে হয়তো আর কোনদিন দেখা হবেনা, তবে স্মৃতিটুকু থেকে যাবে ! 




মূল ভ্রমণ কাহিনী  
বিষদে পড়ার জন্য ক্লিক করুন

First Publish at: http://prabasirchithi.blogspot.com/2014/05/blog-post_10.html
Date: May 31, 2014
Share:

No comments:

Post a Comment

Popular Posts

Recent Posts

Total Pageviews