Geo Tectonic Force (ভূমিরূপ গঠনকারী শক্তি)
Chapter 1.1
সাধারণভাবে ভূপৃষ্ঠের যে অবয়ব বা রূপ যেমন সমভূমি মালভূমি পাহাড় এবং পর্বতকে একসাথে ভূমিরূপ বলা হয়।
পৃথিবীতে সবার প্রথম মহাদেশ ও মহাসাগরের সৃষ্টি হয়েছিল বলে এদের প্রাথমিক ভূমিরূপ বলে।
অপরদিকে সমভূমি মালভূমি পাহাড় পর্বতকে মাধ্যমিক ভূমিরূপ বা দ্বিতীয় পর্যায়ের বা সেকেন্ডারি ল্যান্ডফর্ম বলে।
এরপর বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি যেমন নদী বায়ু হিমবাহ সমুদ্র তরঙ্গ পুঞ্জিত হয় প্রভৃতি এই দ্বিতীয় পর্যায়ের বা মাধ্যমিক ভূমিরূপকে ক্ষয় বহন সঞ্চয়ের মাধ্যমে পরিবর্তন করে যে ভূমিরূপে সৃষ্টি করে তাদের তৃতীয় পর্যায়ের ভূমিরূপ বা টার্শিয়ারি ল্যান্ডফর্ম বলে।
আঁকাবাঁকা নদীপথ, জলপ্রপাত, ব-দ্বীপ, প্লাবনভূমি, ইনসেলবার্জ, গৌড়, ইয়ারদাং, জুইগান, মরুদ্যান, ক্র্যাগ এন্ড টেল, বহিঃবিধৌত সমভূমি, এরিটি, সার্ক বা করি, প্রভৃতি হল তৃতীয় পর্যায়ের ভূমিরূপ।
J A Steer তার Unstable Earth বইতে বলেছেন পৃথিবীর কোন অংশে সুস্থিত নয়।
অর্থাৎ পৃথিবীর ভূমিরূপ গুলি দীর্ঘদিনের ব্যবধানে নিজেদের উচ্চতা ও রূপ পরিবর্তন করছে।
যে শক্তির দ্বারা ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন সাধন ঘটে তাকে ভূমিরূপ গঠনকারী শক্তি বা টেকটনিক ফোর্স বলে।
গ্রিক শব্দ টেকটন কথার অর্থ নির্মাতা।
এই শক্তির দ্বারা ভূমিরূপের গঠন বা নির্মাণ হয় বলে একে টেকনিক ফোর্স বা Diastrophism বলে।
এই ভূমিরূপ গঠনকারী শক্তি আকস্মিক বা হঠাৎ করে সৃষ্টি হতে পারে আবার ধীর প্রক্রিয়ায় কাজ করতে পারে।
ভূমিকম্প অগ্নুৎপাত প্রভৃতির দ্বারা হঠাৎ করে ভূমিরূপের পরিবর্তন হতে পারে বলে একে আকস্মিক প্রক্রিয়া বা Sudden Movement বলে।
মানব সভ্যতার উপর এই আন্দোলনের খারাপ প্রভাব বেশী পরলেও ভূমিরূপের উপর প্রভাব নগন্য।
অপরদিকে যখন কোটি কোটি বছর ধরে ভূমিরূপের ধীরে ধীরে উত্থান বা অবনমন ঘটে তাকে ধীর প্রক্রিয়া বলে।
এই ধির প্রক্রিয়াকে আবার মহীভাবক আলোড়ন ও গিরিজনি আলোড়নে বিভক্ত করা যায়।
গ্রিক শব্দ Epeiros কথার অর্থ হল মহাদেশ।
Epeirogenic Movement বা মহিভাবক আলোড়নে পৃথিবীতে মূলত মহাদেশ ও মহাসাগরের সৃষ্টি হয়েছিল।
মহিভাবক আলোড়ন পৃথিবীর ব্যাসার্ধ বরাবর বা উলম্ব বা খাড়াভাবে কাজ করে ফলে ভূমিরূপ উপরে উঠে যায় অথবা নিচে বসে যায়।
মহিভাবক আলোড়ন সমগ্র মহাদেশ জুড়ে সম্পন্ন হলেও স্থানীয় ভাবে এর ফলাফল বেশি দেখা যায়।
এই আলোড়নে বিশাল আয়তন মালভূমি, গ্রস্ত উপত্যকা, চ্যুতি, স্তুপপর্বত , ভৃগুতট প্রভৃতি সৃষ্টি হয়।
যে ভূগাঠনিক প্রক্রিয়া, পৃথিবীর স্পর্শক বরাবর অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের সাথে অনুভূমিকভাবে কাজ করে তাকে গিরিজনি আলোড়ন বা Orogenic Movement বলে।
গ্রিক শব্দ Oros কথার অর্থ হল পর্বত।
গিরিজনি আলোড়নের ফলে শিলাতে ভাঁজ পড়ে এবং ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি হয়।
গিরিজনই আলোড়নের ফলে ইউরোপের জুরা পর্বত, আফ্রিকার আটলাস পর্বত, এশিয়ার হিমালয়, ইউরোপের আল্পস, উত্তর আমেরিকার রকি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দিজ প্রভৃতি ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি হয়েছে।
এই আলোড়নের ফলে শিলাতে যে ভাঁজ পড়ে তার উঁচু অংশগুলোকে ঊর্ধ্বভঙ্গ এবং নিচু অংশগুলোকে অধোভঙ্গ বলে।
প্রবল অনুভূমিক সংকোচন বলের ভাবে যখন ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরে ভাজের সৃষ্টি হয় তাকে বলে Fold বা বলি বা ভাঁজ।
শিলাস্তরের উপর প্রযুক্ত সংকোচন ও সংনমন বলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে শিলাস্তর ফেটে যায় এবং শিলাস্তরে ফাটল ও চ্যুতি বা সংস্র দেখা যায়।
ভাজযুক্ত শিলাস্তরের ঊর্ধ্বভঙ্গে যদি আমরা একটি উলম্ব অক্ষ (Axis) কল্পনা করি তবে তার দুপাশের হেলে পড়া শিলার স্তরকে ভাজের বাহু বা Arm বলে।
অনুভূমিক তলের সাথে ভাঁজের বাহু যে কোণ উৎপন্ন করে তাকে বলে নতি বা Dip.
নতিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায় যেমন প্রকৃত নতি এবং আপাত নতি।
অনুভূমিক তল শিলাস্তরকে যে রেখা বরাবর ছেদ করে তাকে আয়াম বা Strike বলে।
ভূগাঠনিক শক্তির প্রভাবে যখন শিলাস্তরের একটি বড় অংশ খাড়াভাবে উপরে উঠে যায় অথবা বসে যায় তাকে বলে চ্যুতি।
চ্যুতির ফলে ভূপৃষ্ঠের যে অংশটি উপরে উঠে যায় তাকে বলে স্তূপ পর্বত।
ভারতের বিন্ধ পর্বত, সাতপুরা পর্বত প্রভৃতি স্তুপ পর্বতের উদাহরণ।
অপরদিকে দুটি স্তুপ পর্বতের মাঝের অংশ বসে গেলে তাকে গ্রস্ত উপত্যকা বলে।
নর্মদা ও তাপ্তি নদীর উপত্যকা গ্রস্ত উপত্যকার উদাহরণ।
স্যার অ্যালফ্রেড ওয়েগনার তার চলমান মহাদেশ তত্ত্বটি (Continental Drift theory) তিনি ১৯১২ সালে জার্মান ভাষায় প্রথম উপস্থাপন করেন।
১৯২২ সালে জার্মান ভাষায় পরিমার্জিত রূপে ‘Dei Entstehung der Kontinente and Ozeane’ প্রকাশ করেন।
Dei Entstehung der Kontinente and Ozeane এর অর্থ মহাদেশ ও মহাসাগরের উৎপত্তি।
১৯২৪ সালে ওয়েগনারের তত্ত্বটি ইংরেজী ভাষায় প্রকাশের পর বিজ্ঞানী সমাজে সারা ফেলে।
প্রায় ৩৪ কোটি বছর আগে কার্বনিফরাস উপযুগে পৃথিবীতে একটিমাত্র মহাদেশ ছিল।
ওয়েগনার তার মহীসঞ্চরণ মতবাদের যে বিশাল মহাদেশের কথা বলেন তার নাম রাখেন প্যানজিয়া।
প্যানজিয়া কথার অর্থ হল সুবিশাল মহাদেশ বা Super Continent.
প্যানজিয়া কে ঘিরে যে মহাসাগর ছিল তার নাম প্যান্থালেসা।
প্রায় ২০ কোটি বছর আগে ট্রায়াসিক উপযুগে প্যানজিয়া তে ভাঙ্গন ধরে।
ওয়েগনারের মতে অসমানুপাতিক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও জোয়ার এর শক্তির দ্বারা প্যানজিয়া দুই ভাগে বিভক্ত হয়।
প্যানজিয়ার উত্তরভাগের নাম তিনি দেন লরেশিয়া বা আঙ্গারা ল্যান্ড।
প্যানজিয়ার দক্ষিণ ভাগের নাম তিনি দেন গান্ডোয়ানা ল্যান্ড।
প্যানজিয়া দুইভাগে বিভাক্ত হওয়ার ফলে এদের মাঝে যে অগভীর সমুদ্রে সৃষ্টি হয় তার নাম দেন টেথিস।
আজকের ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণসাগর এই টেথিস সাগরের অংশ বিশেষ।
প্রায় ১৩ কোটি বছর আগে জুরাসিক উপযুগে গান্ডোয়ানা ল্যান্ড থেকে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, উপদ্বীপীয় ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও এবং আন্টাকর্টিকা মহাদেশ আলাদা হয়ে যায়।
আফ্রিকা, উপদ্বীপীয় ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এদের মাঝে ভারত মহাসাগরের সৃষ্টি হয়।
এখানে উপদ্বীপীয় ভারত বলতে দক্ষিণ ভারতের কঠিন শিলাযুক্ত অংশকে বোঝানো হয়েছে।
এই সময় লরেশিয়া বা আঙ্গারা ল্যান্ড থেকে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া আলাদা হয়ে যায়।
প্রায় ৬ - ৭ কোটি বছর আগে ক্রিটেসিয়াস উপযুগে উত্তর আমেরিকা, গ্রিনল্যান্ড ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ফলে এদের মাঝে নরওয়েজিও সাগর সৃষ্টি হয়।
উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা যথাক্রমে ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিম দিকে সরে গেলে এদের মাঝে আটলান্টিক মহাসাগর ও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ (West Indies) সৃষ্টি হয়।
এই সময় এশিয়া মহাদেশের পূর্ব দিকে বৃত্তচাপীয় দ্বীপমালার সৃষ্টি হয় এবং প্যান্থালসার অবশিষ্ট অংশ প্রশান্ত মহাসাগর সৃষ্টি করে।
১৯২৪ সালে স্যার আলফ্রেড ওয়েগনারের চলমান মহাদেশ তত্ত্বটি ইংরাজিতে প্রকাশের পর বিজ্ঞানী মহলে সমালোচনার সৃষ্টি হয় যার প্রধান বিষয় গুলি হল ঘটনাবলীর সময়কাল এবং তত্ত্বটিতে প্রযুক্ত শক্তি।
কেন মহীসঞ্চরণ শুধুমাত্র কার্বোনিফেরাস যুগ থেকে ক্রিটেসিয়াস এর মধ্যেই সময়ে সীমাবদ্ধ ছিল, প্যেলিওজোয়িক যুগের আগে মহীসঞ্চরণ ঘটেনি তার ব্যাখ্যা ওয়েগনারের তত্ত্বে পাওয়া যায় না।
ওয়েগনার তার তত্ত্বে যে শক্তির কথা বলেছেন তা মহাদেশগুলির সঞ্চরণে পর্যাপ্ত নয়।
সমালোচনা কাটাতে ওয়েগনার আরো কিছু সময় নেন এবং সমগ্র পৃথিবী ঘুরে তাঁর এই তত্ত্বটির স্বপক্ষে প্রমাণ জোগাড় করতে থাকেন।
উত্তর আমেরিকা মহাদেশের কার্পেন্থিয়ান পর্বত এবং ইউরোপ মহাদেশের জুরা পর্বতে একই প্রকার হার্সেনীয় ও আল্পীয় ভাঁজ দেখা যায় এর থেকে প্রমাণিত হয় উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ আগে একই ভূ-ভাগ ছিল।
পশ্চিম আফ্রিকার নিউগিনি উপকূল এবং ব্রাজিলের উচ্চভূমিতে একই প্রকার প্রাচীন নাইস জাতীয় আগ্নেয় শিলা দেখা যায় যা প্রমাণ করে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা অতীতে একই ভূ-ভাগের অংশ ছিল।
কানাডায় বরফের স্তুপ এর নিচে বালু এবং তার নিচে কয়লার অবস্থান প্রমাণ করে এই স্থানটি নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে উপক্রান্তিয় অঞ্চল এবং বর্তমানে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় জীবিত ক্যাঙ্গারু এবং দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে পাওয়া ক্যাঙ্গারুর জীবাশ্ম প্রমাণ করে এই দুটি স্থান অতীতে যুক্ত ছিল।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গ্লাসোপটেরিস নামক উদ্ভিদ ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদের জীবাশ্ম প্রমাণ করে অতীতে মহাদেশ গুলি একত্রে ছিল।
দেবদারু গাছ শীতল জলবায়ুতে পাওয়া যায় কিন্তু তার জীবাশ্ম কেমন করে রাজস্থানে পাওয়া যায় অথবা ইউরোপের শীতল জলবায়ুতে কেমন করে সুবিশাল কয়লার ভান্ডার সৃষ্টি হয়েছে তার ব্যাখ্যা মহাদেশগুলির সঞ্চরনের মাধ্যমে সম্ভব।
বর্তমানে মহাদেশ গুলির যে আকার দেখা যায় তা থেকে ধারণা করা যেতে পারে একটি মহাদেশের উপকূল এর আকৃতি অপর একটি মহাদেশের উপকূলের আকৃতির প্রায় সমান যেন এরা একটি ভাঙ্গা বস্তুর অংশ বিশেষ।
ওয়েগনার একে ভাঙ্গাবস্তুর জোর বা Gig Saw Fit নাম দেন।
বিখ্যাত জলবায়ুবীদ ভ্লাদিমির কোপেন মনে করেন বর্তমানের মেরু অঞ্চল ও বিষুব অঞ্চল গুলির অবস্থান অতীতে আলাদা আলাদা স্থানে ছিল যা ওয়েগনারে তত্বকে সমর্থন করে।
পুরাতন শিলার চুম্বকত্বের নতি অধ্যয়ন করে দেখা গেছে বিভিন্ন ভূ-তাত্ত্বিক যুগে পৃথিবীর মেরুর অবস্থান বিভিন্ন স্থানে ছিল যাকে মেরুভ্রমন বা Polar wandering বলে।
ওয়েগনার মেরুর এই স্থান পরিবর্তনকে Pohlfluchlt নামে আখ্যা দেন।
বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক যুগের প্রাচীন বরফের সঞ্চয় দেখায় অতীতে মহাদেশ গুলি একত্রিত অবস্থায় ছিল।
প্রসঙ্গত ওয়েগনারের চলমান মহাদেশীয় তত্ত্বটি আজও একটি বিতর্কের বিষয় তবে স্যার গ্রিফিট টেলর, আর্থার হোমস্ মনে করেন এর মধ্যে কিছু বৈজ্ঞানিক সত্য লুকিয়ে রয়েছে।